সামনেই কালীপুজো। দুর্গাপুজোর জাঁকজমক মানে যদি কলকাতা হয়, তবে কালীপুজো অবশ্যই বারাসতের। শক্তির আরাধনায় বারাসতের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া ভার। কালীপুজো মানেই চোখধাঁধানো আলোর রোশনাই, আর আকর্ষনীয় সব মণ্ডপসজ্জা। পুজোর ক'টা দিন লাখো মানুষের ভিড় হয় বারাসতে। রাতভর চলে এক মণ্ডপ থেকে আর এক মণ্ডপ ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখা। বারাসতের কালীপুজোর পরিচিতি জেলার গণ্ডি টপকে গোটা রাজ্যে ছড়িয়েছে।
মহাদেব ঘোষের হাত ধরে বারাসতের কালীপুজোর এই জাঁকজমকের সূচনা। মহাদেবের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরীরা সেই ধারা বহন করে চলেছেন। সেইসঙ্গে একে একে নতুন নতুন পুজো শুরু হয়েছে। ধারে-ভারে যেগুলি রীতিমতো একে অপরকে টেক্কা দেয়। যেমন এই বছর মণ্ডপসজ্জায় কোথাও দেখা যাবে হারিয়ে যাওয়া বাংলার সংস্কৃতি আবার কেউ বানাচ্ছেন ৯৯ কেজির রুপো দিয়ে তৈরি কালীমূর্তি।
বারাসতের বড় বাজেটের পুজো মানেই কেএনসি রেজিমেন্ট। আলো থেকে মণ্ডপসজ্জায় অন্যদের থেকে বরাবরই আলাদা কিছু করার চেষ্টা করেন উদ্যোক্তারা। কেএনসি রেজিমেন্টের পুজো এ বার ৬০ বছরে পড়ল। এই বছর উদ্যোক্তাদের ভাবনায় কালচারাল হেরিটেজ অফ বাংলা। আগে বাংলার মানুষ পালকি, গোরুর গাড়ি, হাওদায় চড়ে যাতায়াত করতেন। হাওদা মানে হাতির পিঠে সওয়ার হওয়া। হাতি এবং পালকি সাধারণত ব্যবহার করতেন রাজা এবং জমিদারেরা। হারিয়ে যাওয়া বাংলার এই সংস্কৃতিকেই কালীপুজোর মণ্ডপসজ্জায় তুলে ধরেছেন উদ্যোক্তারা। ডোকরা এবং জুট দিয়ে অসাধারণ শিল্প নৈপুন্যে কালচারাল হেরিটেজ অফ বাংলা তুলে ধরেছেন শিল্পী গৌরাঙ্গ কুইলা।
বারাসতের পাইয়োনিয়ার অ্যাথেলেটিক ক্লাব বরাবরের মতোই এ বারেও চমক দিতে চলেছে তাদের মণ্ডপসজ্জায়। ৪৭ বছরে তাদের ভাবনা থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্ককের একটি বুদ্ধ মন্দির। এই মন্দির থাইল্যান্ডের আদি থনবুড়ি রাজ্যের চাও ফারায়া নদীর তীরে ১৮২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। বিখ্যাত এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন থাই-চিনা ব্যবসায়ী চাও পারায়া নিকোনবোদিন। পরবর্তীতে তিনি সিয়াম রাজবংশীয় রাজা তৃতীয় রামকে দান করেন। বৃহত আকারের সোনার বুদ্ধের মুর্তি এই মন্দিরের বিশেষ আকর্ষণ। পাইয়োনিয়ারের মণ্ডপের সামনের বড় জলাশয় মন্দিরের আকর্ষণ কয়েকগুন বাড়িয়েছে।
বারাসতের মৎস্য আড়তদার সমিতির কালীপুজো এ বছর ২৮তম বর্ষে পা দিল। এখানে ৯৯ কেজি রুপোর কালীমূর্তি তৈরি হচ্ছে। বারাসতে ভিন্নধারার মণ্ডপ থেকে আলোকসজ্জায় নানা বাহার দেখা গেলেও রুপোর কালীপ্রতিমা এর আগে দেখেননি বারাসতের মানুষ। সেদিক থেকে এই বছর বড় চমক দিচ্ছে মৎস্য আড়তদার সমিতির পুজো। পুজোর ক'টা দিন ৬৫ লাখের রুপোর কালীপ্রতিমা পাহারার জন্য থাকছে আঁটসাট নিরাপত্তার ব্যবস্থা। মণ্ডপসজ্জায় উদ্যোক্তাদের ভাবনা সঙ্কল্প। শিশুশ্রমিক থেকে বাল্যবিবাহের মতো মানবসমাজের বিভিন্ন খারাপ বিষয়গুলি রুখতে মানুষকে সঙ্কল্প নেওয়ার বার্তাই দিতে চাইছেন মাছ ব্যবসায়ীরা।
বারাসতের সন্ধানীর কালীপুজো এ বার ৫৯ বছরে পড়ল। মণ্ডপসজ্জায় উদ্যোক্তাদের ভাবনা, এখনও আধারে। শিশুশ্রম আইনের চোখে দণ্ডনীয় অপরাধ। শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সরকারি এবং বেসরকারি স্তরে লাগাতার প্রচার চলেয় কিন্তু আমাদের চারপাশে হাটেবাজারে, চায়ের দোকানে, রাস্তার ধারের হোটেলে, রেস্তোরাঁয় শিশু শ্রমিকদের হামেশাই দেখা যায়। শিশুশ্রমিকের একটা বড় অংশ কাজ করে ইটভাটায়। তাই ইট বয়ে বা চায়ের দোকানে,রেস্তোরাঁ, হোটেলে খাবারের থালা, গ্লাস মেজেই এদের শৈশব হারিয়ে যায়। পুজোর আনন্দ থেকে শিশুশ্রমিকরা থাকে শত যোজন দূরে। ছ'হাজার স্কোয়ার ফিট জুড়ে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে মানুষকে বার্তা দিতেই মণ্ডপ সাজিয়েছে সন্ধানী। চায়ের ভাড়, চামচ, টি-ব্যাগ, স্টোভের ফিতে, চা ঢালার ছাকনি দিয়েই তৈরি হচ্ছে সন্ধানীর মণ্ডপ। চন্দননগরের আলোকসজ্জায় ফুটিয়ে তোলা হবে শিশুশ্রমের বেদনাদায়ক চিত্র।
এ ছাড়াও বারাসতে বড় বাজেটের পুজো উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম বিদ্রোহী স্পোর্টিং ক্লাব। ৫৩ বছরে উদ্যোক্তাদের ভাবনা হিন্দু ধর্ম। মণ্ডপসজ্জায় এক দিকে যেমন থাকছে বৃন্দাবন ধাম। অন্যদিকে থাকছে জগন্নাথের মূর্তি। মূল মণ্ডপটি গড়ে উঠছে শিবমন্দিরের আদলে।
Source: Ei Samay