বাধা পেরিয়ে স্বপ্নের উড়ানে সওয়ার ওরা৷ মেধার পথে কোথাও থাবা বসিয়েছিল দারিদ্র্য, কোথাও দুঃস্বপ্নের স্মৃতি৷ কিন্ত্ত সেগুলো পেরিয়েই উচ্চ মাধ্যমিকের আঙিনায় ঝলমল করছে বারাসতের রিয়া, নিমতার অনিরুদ্ধ, মাথাভাঙার অশোক, কালনার সৌরভ৷ মেধাতালিকায় স্থান পাওয়াটাই এখানে শেষ কথা হয়নি৷ বরং জীবনের যে কোনও ধরনের বাধার সামনে কী ভাবে বুক চিতিয়ে লড়াই করা যায়, চার পড়ুয়ার মানসিকতায় ধরা পড়েছে সেই রহস্যেরই রামধনু৷
যেমন রিয়া ঘোষ৷ উচ্চ মাধ্যমিকে যুগ্ম ভাবে নবম স্থানে থাকা মেয়েটার যখন চার বছর বয়েস, অনেকে তাকে ঘরে তুলতে বারণ করেছিল৷ মা খুন হয়েছেন, সেই ঘটনায় বাবা হাজতে৷ রিয়ার জেঠিমাকে প্রতিবেশীরা বলেছিলেন, ‘ও মেয়েকে ঘরে রাখছ কেন? বিয়ে দেবে কেমন করে? অভাবের সংসারে বোঝা না-হয়ে যায়৷’ মানেননি জেঠিমা৷ আজ তিনি আঁচলে চোখ মুছে গর্বের সঙ্গে সবাইকে জানাচ্ছেন, রিয়া কারও বোঝা হয়নি৷ সব বাধা দূরে সরিয়ে বারাসতের মাধবপুরের রিয়া আজ কন্যাশ্রী!
অথচ কতটা দুঃসহ স্মৃতি বয়েছে সে৷ চোখের সামনে মায়ের ঝুলন্ত দেহ দেখেছিল মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়েসে৷ পুলিশ এসে বাড়ি লাগোয়া গোয়ালঘর থেকে দেহ উদ্ধার করেছিল৷ মা-মরা মেয়েকে বাবা আগলে রাখবেন, এত ভালো কপাল রিয়ার ছিল না৷ স্ত্রীকে খুনের অভিযোগে বাবা হারান ঘোষকেও জেলে যেতে হয়৷ রিয়ার জীবনটা তখন থেকেই ঝড়ের মুখে৷ ছ’বছরের বড় দাদাকে মামাবাড়ির লোকজন নিয়ে গিয়েছিল৷ নেয়নি রিয়াকে৷ দাদার পিছন পিছন বেশ খানিকটা দৌড়েছিল একরত্তি মেয়েটা৷ মামারা ফিরেও তাকায়নি৷ জ্যাঠতুতো দাদা দেখতে পায়, আটঘরা কালীমন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে ছোট্ট রিয়া৷ তার পর থেকেই জ্যাঠার ঘরে ভাগ্যজয়ের লড়াই শুরু রিয়ার৷ চার বছর পরে রিয়ার বাবা যখন ছাড়া পান, তখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন৷ এখনও তিনি ‘বন্দি’ বাড়িরই একটা ঘরে৷ এত যন্ত্রণা সয়েও সেই মেয়ে প্রথম দশে?
উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সাংবাদিক বৈঠকে যখন কালীকৃষ্ণ গার্লস হাইস্কুলের রিয়া ঘোষকে নবম ঘোষণা করা হচ্ছে, তখন বাড়িতে বসে ভাগচাষি জ্যাঠা জয়দেববাবু চোখে জল নিয়ে বলছিলেন, ‘ভাবতে পারবেন না, কী ভাবে দিনে ২৬-২৭ কিলোমিটার সাইকেল ঠেঙিয়ে বারাসতে গিয়ে পড়াশোনা চালিয়েছে মেয়েটা৷ উচ্চমাধ্যমিকে স্কুল থেকে শুরু করে কোচিং ক্লাস-- সবই মাধবপুর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরের জেলাসদরে৷’ জেঠিমা মেনকাদেবীর কথায়, ‘ভোর চারটেয় উঠে টিফিন তৈরি করে দিতাম৷ খেয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যেত ভোরবেলাই৷ স্কুল, কোচিং সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অন্তত রাত দশটা৷ ওর জ্যাঠা মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত অপেক্ষায়৷’ সে অপেক্ষা বৃথা যায়নি৷ মা-বাবার কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে যায় রিয়ার৷ তবু সে বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখে৷ বলে, ‘বেসরকারি কলেজে পড়ানোর ক্ষমতা নেই জ্যাঠা-জেঠিমার৷ কিন্ত্ত ডাক্তার হতে চাই৷ দেখা যাক কী হয়’৷
এমন একটা অনিশ্চয়তার জীবন ছোট থেকে দেখেছে অনিরুদ্ধও৷ বেলঘরিয়ার বাড়ি থেকে স্টেশন আধঘণ্টার পথ৷ অটোর ভাড়া থাকত না বলে হেঁটেই যেতে হত৷ তার পর শিয়ালদহে নেমে ফের কলেজ স্ট্রিট অবধি হেঁটে হেয়ার স্কুল৷ বাড়ি ফেরার সময়ও একই উপায়৷ গোটা পথে সঙ্গী বলতে দারিদ্র্য৷ নিমতার আলিপুর বাজারের সেই অনিরুদ্ধ রায়ই এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে পঞ্চম৷ বাবা অসীম রায় প্রিন্টিংয়ের কাজ করে যা আয় করতেন, তাতে ছেলেকে ভালো স্কুলে পড়াশোনা করানো প্রায় অসম্ভব৷ মা তাপসীদেবী যে কিন্ডারগার্টের্ন স্কুলে পড়াতেন, তা-ও বন্ধের মুখে৷ বারো বছর ধরে একটা ঘরে ভাড়া থাকা৷ সেই ঘরেই মায়ের রান্না, বাবার কাজ৷ তার মধ্যেই চলত অনিরুদ্ধর পড়াশোনা৷ প্রাইভেট টিউটরের কথা মাথাতেও আসেনি৷ একটা সময় বাবা-মা ভেবেছিলেন, আর হয়তো অনিরুদ্ধর স্কুলে যাওয়া হবে না৷ টাকা নেই৷ মাধ্যমিকের পর অনিরুদ্ধর পড়াই হত না, যদি না স্কুলের শিক্ষকরা আর্থিক ভাবে পাশে দাঁড়াতেন৷ যুদ্ধজয়ের এই দিনে তাই অনিরুদ্ধর ধন্যবাদ সেই শিক্ষাগুরুদের প্রতিও৷ বই-খাতা, পেন-পেন্সিল, প্র্যাকটিক্যালের সরঞ্জাম-- সবই তো শিক্ষকদের দেওয়া৷ আর কিছু স্বজনের সাহায্য৷ তাই প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করে একজন সফল শিক্ষক হতে চায় অনিরুদ্ধ৷ কৃতীর কথায়, ‘যাঁদের আদর্শ মেনে বড় হয়েছি, তাঁদের পেশাটা ভুলি কী ভাবে? ঋণশোধের কথা ভাবতে পারি না৷ কিন্ত্ত প্রতিসম্মান জানাতে শিক্ষকই হই৷ পড়ানোটা আমার বেশ লাগে৷’
প্রতিসম্মান দিতে চায় সৌরভ দাসও৷ নিজের মা’কে৷ কালনা শহরের এই মেধাবী ছাত্র মেধাতালিকায় নেই৷ ৮৭% পেয়ে নিজের স্কুল মহারাজা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সে প্রথম৷ যদিও শুধুই সেটা সৌরভের ‘পরিচয়’ নয়৷ তার সাফল্যের রুটিনে দু’বেলা গৃহশিক্ষকের সাহায্যে পড়া নেই৷ বরং রয়েছে জল তোলা, বাসন মাজার রোজনামচা৷ তার ফাঁকেই পড়াশোনা৷ একচিলতে টালি-টিনের চাল আর দরমার বেড়ার ঘরে মাকে নিয়ে বাস সৌরভের৷ মা সারা দিন ব্যস্ত বিড়ি বাঁধার কাজে৷ আর তাই সৌরভকেই হাত লাগাতে হত সংসারে৷ অথচ এমনটা না-ও হতে পারত৷ চায়ের দোকান ছিল বাবার৷ একটু কষ্ট হলেও সবই ঠিকঠাক চলছিল সৌরভের জীবনে৷ সে যখন ক্লাস এইটে, হঠাত্ বেপাত্তা হয়ে গেলেন বাবা৷ মা প্রথমে ছেলেকে জানাননি, এ সংসারে বাবার মন ছিল না৷ তবে হালও ছাড়েননি রিনা, সৌরভের মা৷ বিড়ি বেঁধে সংসার চালিয়েছেন৷ বন্ধ হতে দেননি ছেলের পড়াশোনা৷
আর তাই হয়তো রেজাল্টটা হাতে নিয়ে ছেলে বাড়ি ফিরতেই চোখের জল বাধ মানেনি রিনাদেবীর৷ তবে এ জয়ের কান্না৷ মায়ের কথায়, ‘স্বামী চলে যাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, পাঁচ জনের কাছে হাত পেতে হলেও ছেলের পড়াশোনা চালাব৷ পাশাপাশি শুরু করি বিড়ি বাঁধার কাজ৷ রোজ ৫০০টা বিড়ি বাঁধলে মজুরি মেলে ৫০ টাকা৷ রোজকার খাবার আলুসেদ্ধ-ভাত৷’ সৌরভের মামা পাশে ছিলেন, স্কুলের শিক্ষকরাও বিনা পারিশ্রমিকে পড়িয়েছেন সৌরভকে৷ নাতির সাফল্যে গর্বিত সৌরভের ঠাকুমা বুলু দাস৷ চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, ‘ছেলে সংসারটাকে ভাসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল৷ ওর মুখ দেখতে চাই না আর৷ তবে নাতির জন্য ভীষণ খুশি হয়েছি৷’ ভবিষ্যতে ভূগোলের শিক্ষক হতে চায় সৌরভ৷ সে জানাল, ‘বাবার অভাব পূরণ করে দিয়েছে মা৷ তবুও ইচ্ছে আছে, বাবাকে একবার রেজাল্টটা দেখিয়ে আসব৷ জিজ্ঞাসা করব, আমরা কী দোষ করেছিলাম৷’ দোষ ছিল না মাথাভাঙার বিবেকানন্দ হাইস্কুলের অশোক বর্মনেরও৷ কিন্ত্ত জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যের ছায়াটাও ছিল না৷ মাত্র ৬ নম্বরের জন্য মেধাতালিকায় নাম তুলতে না-পারলেও লড়াইয়ের গরিমায় কৃষক বাবার মাথা তুলে দিয়েছে আকাশে৷ কোচবিহার জেলার শিকারপুর এলাকার বিজিকুটা গ্রামের বাসিন্দা অশোক৷ বাবা দেবীচরণ বর্মন নিজেদের বিঘা তিনেক জমিতে চাষ করে যে সামান্য আয় করেন, তা দিয়েই দু’বেলা দু’মুঠোর সংস্থান হয় পরিবারের৷ চাষের কাজে বাবাকে সাহায্য করত অশোক৷ সংসারের হাল ধরতে দোকানেও কাজ করতে হয়েছে৷ তবু ছেদ পড়েনি পড়াশোনায়৷ ৪৬১ পেয়ে সেই নাছোড় মনোভাবটাই দেখাচ্ছে অশোক৷
মাধ্যমিকে ভালো ফলের পর ছ’জন গৃহশিক্ষক বিনেপয়সায় তাকে পড়াতে শুরু করেন৷ শুক্রবার সেই শিক্ষকদের কাছেই নিজের রেজাল্টের খবরটা পেয়েছিল অশোক৷ ছাত্রের রেজাল্টে উচ্ছ্বসিত রসায়নের গৃহশিক্ষক মোস্তাফা সাফিক আমাল খন্দকার বলছেন, ‘এত দিনের পরিশ্রম সার্থক হল৷ অশোক খুব খেটেছে৷ প্রথম যখন এসেছিল, তখন গুছিয়ে কথা বলতে পারত না৷ নার্ভাস হয়ে পড়ত৷ সেই সব কাটিয়ে উঠেছে৷’
শুধু তো সেই বাধা নয়, বাড়ি থেকে দূরে ভাড়া করা ঘরে দিনের পর দিন থেকে শহরের স্কুলে পড়াশোনার সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে অশোক৷ গ্রাম থেকে কখনও বাবা-মা এসে রান্না করে দিতেন৷ সেই ছেলেই এ বার চায় অধ্যাপক হতে৷ স্বপ্নের উড়ান তো এমনই হয়!
Source: Ei Samay