বারাসত একটি আরবি শব্দ। অর্থ অ্যাভিনিউ। বাংলার বারো জন শেঠের বসতি ছিল বলেই এলাকার নামকরণ হয় বারাসত। স্থানীয় ঐতিহাসিকরা তেমনই বলে থাকেন। সেই বারাসত বড়ই মনে ধরেছিল সাহেবদের। আজ কলকাতার রেসকোর্সের কথা গোটা দেশ জানলেও, ঘৌড়দৌড় কিন্তু কলকাতার আগেও শুরু হয়েছিল বারাসতে। দেশে প্রথম। হেস্টিংস আমলে ব্রিটিশদের আনাগোনা বারাসতে আরও বাড়ে।
বারাসতের উত্তরে বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস সুন্দর একটা ভিলা বানিয়েছিলেন। জেলায় ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম এই হেস্টিংস ভিলা। ইংরেজ শাসনের প্রতীক হিসেবে আজও বারাসত শহরের বুকে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই ভিলা। তবে সংস্কারের অভাবে সেই জৌলুস আর নেই। জীর্ণ ভিলা আজ গায়ে বিপজ্জনক বোর্ড ঝুলিয়ে বুঝি বা সংস্কারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।
ইতিহাস প্রসিদ্ধ বাড়িটির বর্তমান অবস্থা বড়ই করুণ। সংরক্ষণের অভাবে ধুঁকছে। স্রেফ সরকারি উদাসীনতায় ব্রিটিশ স্থাপত্যটি অবহেলায়, অনাদরে আজ ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে। ইতিমধ্যেই ইন্ডিয়ান আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বাড়িটিকে বিপজ্জনক ঘোষণা করেছে। অথচ এই বাড়ির প্রতিটি ইটে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস।
আনুমানিক সতেরশো সালে তৎকালীন ইংরেজ গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস আমোদপ্রমোদের জন্য এই ভিলা বানিয়েছিলেন। দোতলা সুন্দর ছিমছাম বাড়িটির উত্তরের সদর দরজার দিকে এখনও একটি ফলক দেখা চোখে পড়ে। যে ফলকে লেখা রয়েছে ‘ইন দিস হাউস লিভ লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস।’
বড়লাটের ভিলার মেঝে ওক কাঠ দিয়ে তৈরি। একতলা-দোতলা মিলিয়ে আটটি ঘর। এক তলার ভিতর দিয়েই ওপরে ওঠার সিঁড়ি। দেওয়াল জুড়ে পুরোনো স্থাপত্যের নিদর্শন। রয়েছে বলরুম। বারবনিতারা এখানে নাচতেন বলেও শোনা যায়। সপ্তাহান্তে আনন্দ ফুর্তির জন্য এই হেস্টিংস ভিলাকেই বেছে নিতেন ইরেজরা। বিশাল বাড়িটি জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে স্থাপত্য, শৈলির অপূর্ব নিদর্শন। হেস্টিংস ভিলা থেকে প্রশাসনিক ট্রেজারি ভবন পর্যন্ত একটা সুড়ঙ্গ ছিল। সেই সুড়ঙ্গ এখন আর নেই।
নানা ঐতিহাসিক ঘটনার নিরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে হেস্টিংস ভিলা। নিম্ন গাঙ্গেয় বঙ্গের উর্বরা কৃষি অঞ্চল বারাসত। চাষিদের বহু আন্দোলনের আঁচ এসে পড়েছে এই হেস্টিংস ভিলায়। কৃষক নেতা তিতুমিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এই বাড়ি থেকেই করেছিল ইংরেজরা। আবার চাষিরা নীলচাষ করতে বাধ্য নয়, এমন ঐতিহাসিক আদেশও সম্ভবত এসেছিল এই ভিলা থেকেই।
এই ভিলা ঘিরে ইংরেজ বসতিও গড়ে উঠেছিল। হেস্টিংস ভিলার অদূরেই ছিল নীল পুকুর। নীলকর সাহেবদের বাংলো, চাকরদের থাকার বন্দোবস্ত সবই ছিল সেখানে। কাছাকাছির মধ্যেই ছিল ইংরেজদের রক্ষিতাদের থাকার ঘর। শোনা যায় নীলকর সাহেবদের প্রিয় দুই রক্ষিতার এক জন চাঁপা। অপর জন ডালি। বলা হয় ওই দু’জনের নাম থেকেই চাঁপাডালির মোড়।
দেশ ভাগের পর হেস্টিংস ভিলাকে জেলার কালেক্টর অফিস বানানো হয়। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উত্তর চব্বিশ পরগনার ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে দু’বার বারাসতে বদলি হয়ে আসেন। তখন হেস্টিংস ভিলাতেই ছিল তাঁর দপ্তর। ১৮৭৪ সালের চৌঠা মে বঙ্কিম বারাসতে আসেন। সেই বছরই ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি মালদহে বদলি হয়ে যান। ১৮৮২ সালে ফের বারাসতে আসেন বঙ্কিমচন্দ্র। কিন্তু দ্রুতই আলিপুর ফিরে যান বঙ্কিম। প্রথম দফায় পাঁচ মাসের কম ছিলেন তিনি। আর দ্বিতীয়বার তো হাতে গোনা কয়েকটা দিন। অল্পদিনের জন্য হলেও এই হেস্টিংস ভিলা সাহিত্য সম্রাটের পদধূলিধন্য।
যে বাড়িকে ঘিরে এত ইতিহাস, সেই বাড়ি আজ অবহেলায়, অনাদরে পড়ে আছে। ১৯৬৮ সালে সরকারি ভাবে হেস্টিংস ভিলাকে জীর্ণ ঘোষণা করা হয়। ইতিহাস প্রসিদ্ধ হেস্টিংস ভিলাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে বহু বছর আগে বারাসতের কয়েক জন সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ জেলাশাসকের কাছে সংস্কারের দাবি জানান। কিন্তু সেভাবে সাড়া পাওয়া যায়নি।
২০১৬ সালে বাড়িটির সংস্কারের কাজে একবার হাত দেওয়া হয়েছিল। খানিক সংস্কারও হয়েছিল। কিন্তু অজানা কোনও কারণে সেই সংস্কার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন হেস্টিংস ভিলায় পা রাখলে দেখা যাবে বাড়ির চারপাশে লোহার রড বাঁধা। একসময়ে সংস্কারের কাজ যে শুরু হয়েছিল তা পরিষ্কার। ভিলার সামনে কয়েকটা নোটিস টাঙ্গানো। একটিতে লেখা ‘বিপজ্জনক বাড়ি’। নোটিস রয়েছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ারও। বক্তব্য, এই বাড়ির দুশো মিটারের মধ্যে কোনও বাড়ি বানানো যাবে না। একশো মিটারের মধ্যে কোনও খননকাজ করা যাবে না। এই নিয়ম ভাঙলে জরিমানা এবং কারাদণ্ড হবে। হেস্টিংস ভিলার গাড়িবারান্দা অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। অনেক জয়াগায় ছাদ খসে পড়েছে। বাড়ির দোতলার ছাদের একটা অংশ ভেঙে গিয়েছে। বাড়ির কার্নিসে যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে বট-অশ্বত্থ গাছ। অতি দ্রুত হেস্টিংস ভিলার সংস্কার না হলে, চিরতরে হারিয়ে যাবে ঐতিহাসিক এই স্থাপত্য নিদর্শন।
হেস্টিংস ভিলা সংস্কার প্রসঙ্গে জেলাশাসক অন্তরা আচার্য বলেন, ‘এটা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার বিষয়। ওরা এই নিয়ে আমাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা করে না।’ বারাসতের প্রবীন নাগরিক তথা লেখাক গৌর মিত্র বলেন, ‘হেস্টিংস ভিলা হেরিটেজের তকমা পেয়েছে। এই বাড়ির সঙ্গে ইংরেজদের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। এখানে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে গিয়েছেন। ইতিহাস এবং আবেগের সাক্ষী বহন করছে হেরিটেজ ভবনটি। এর আশু সংস্কার প্রয়োজন।’ গৌর মিত্র জানান, তিনি ভিলা সংস্কারের জন্য আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার কাছে কাছে অনুরোধ করবেন।
বারাসত পুরসভার পুরপ্রধান সুনীল মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘বারাসত পুরসভা ইতিহাস প্রসিদ্ধ হাতিপুকুরকে নতুন কলেবরে তুলে ধরছে। যদি হাতিপুকুরের মতো হেস্টিংস ভিলাও লিজে পাওয়া যায়, তবে তা সংস্কারের কাজ খোদ পুরসভাই শুরু করে দেবে।’
Source: Ei Samay