কাদামাখা ছোটবড় চলমান পায়ের সারি৷ ছেলে -বুড়ো সকলেরই হাতে মাথায় নানা মাপের পুঁটুলি৷ চোখমুখে আতঙ্ক৷ আদিগন্ত মাঠে আঁকাবাঁকা রেখা৷ টিভিতে প্রকৃতির ক্যানভাস জুড়ে ছিন্নমূল মানুষের এই চলমান ছবি দেখে অনাদির মনে ভেসে উঠছে বছর পঞ্চাশ আগের টুকরো টুকরো কিছু ছবি৷ ইরাবতী নদী৷ মানুষে ঠাসা বড় বড় নৌকো৷ টালমাটাল বঙ্গোপসাগরে দুলতে দুলতে দিন তিনেক পর সুন্দরবনে এসে থামা৷ সেখান থেকে স্টিমারে হাসনাবাদের রিফিউজি ক্যাম্প৷ শরণার্থী শিবির৷
কোনওটা বনগাঁয় , কোনওটা বারাসতে , কোনওটা রানাঘাটে৷ অনাদি রায়৷ ১৯৬৭ তে বছর ১৫ বয়সে পরিবারে সঙ্গে জন্মভূমি বর্মা ছেড়ে উদ্বাস্ত্ত হয়ে ভারতে এসেছিলেন৷ তাঁর কথায় ,‘আমরা শরণার্থী ! আজন্ম রেঙ্গুনে পাকা বাড়িতে থেকে অভ্যস্ত৷ সেই আমাদের থাকতে হবে অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে ক্যাম্পে ! খাবারের জন্য থালা হাতে লাইনে দাঁড়াতে হবে ! কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না৷ মনটা ডুকরে কেঁদে উঠছিল৷ ’ টিভিতে রোহিঙ্গাদের ছবি দেখে মনটা ভারী হয়ে উঠছে৷ ফের তাঁর মনে ভেসে আসছে শরণার্থী জীবনের ছবি৷
তিনি বলেন , ‘আস্তে আস্তে রেঙ্গুনের জীবন ফিকে হয়ে গেল৷ এ দেশের সরকার বনগাঁয় জমি -বাড়ি দিল৷ ’ রোহিঙ্গাদের যে জন্য মায়ানমার ছেড়ে উদ্বাস্ত্ত হতে হচ্ছে তার ঠিক উল্টো কারণে অনাদির মতো প্রায় লাখ তিনেকেরও বেশি ভারতীয়কে সেদিনের বর্মা অর্থাত্ আজকের মায়ানমার ছাড়তে হয়েছিল৷ সেদিন বর্মা সরকার সে দেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের বলেছিল , বর্মায় থাকতে হলে বর্মার নাগরিকত্ব নিতে হবে৷ ভারতীয়দের একটা বড় অংশই সে প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি৷ ইন্দিরা গাঁধী এবং বর্মার জুন্টা সরকারের প্রধান জেনারেল নে উইনের মধ্যে একটি চুক্তি হয়৷ সেই চুক্তির দরুণ সে দেশে থাকতে অনিচ্ছুক তিন লক্ষেরও বেশি ভারতীয় উদ্বাস্ত্তকে এ দেশে আশ্রয় দেওয়া হয়৷ মূলত পশ্চিমবঙ্গে৷ কারণ ওই ভারতীয় উদ্বাস্ত্তদের অধিকাংশই বাঙালি৷ ইতিহাস বলছে , বর্মায় ভারতীয়দের বসবাস দু’হাজার বছরেরও আগে থেকে৷ শরত্চন্দ্রের গল্পে বারবার উঠে এসেছে বর্মার পটভূমি৷ বর্মা যেন বাংলারই অংশ৷ ব্রিটিশ আমলে সংখ্যাটা সবচেয়ে বেশি দাঁড়ায়৷ বর্মা থেকে ভারতীয়দের ভারতে ফিরে আসাও শুরু হয় ওই ব্রিটিশ আমলেই৷ ১৯৪২ -এ৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন জাপানিরা বর্মা পৌঁছয় তখন থেকে৷ ব্রিটিশ সরকারের কর্মচারী হিসেবে ভারতীয়দের ভূমিকা পছন্দ করত না সাধারণ বার্মিজরা৷ জাপানিরা সে দেশে আসার পর তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মূলত সরকারি চাকরি নিয়ে যাওয়া ভারতীয়দের উপর বার্মিজরা অত্যাচার শুরু করে৷ বহু ভারতীয়ের মৃত্যুও হয় বার্মিজদের হাতে৷ সে সময় এক রকম বাধ্য হয়েই বহু ভারতীয় বর্মা ছেড়ে চলে আসে৷
বর্মার নাগরিকত্ব কেন নেননি জানতে চাইলে বারাসতের বর্মা কলোনির বাসিন্দা ৮২ বছরের বৃদ্ধা সাবিত্রী ভট্টচার্য পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন ‘কেন নেবো ?’ একটু থেমে ব্যাখ্যা করে বলেন , ‘লেখাপড়া , কাজকর্ম সব কিছুই তা হলে বার্মিজ ভাষায় করতে হত৷ নিজেদের সংস্কৃতি ছুড়ে ফেলে দিয়ে বর্মার সংস্কৃতিকেই আপন করে নিতে হত৷ তাই , বোধ হয় পরিবারের বড়রা ভারতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ ’ ১৯৪৭ -এ রেঙ্গুনে জন্ম রানি মজুমদারের৷ থাকতেন মিনিগাঁওয়ের সাঙ্গন স্ট্রিটে৷ লেখাপড়া , বিয়ে -থা সব কিছুই বর্মাতে৷ ‘এমনকী শাড়ি নয় , পরতাম বার্মিজ লুঙ্গি৷ কিন্ত্ত , যখন দেখলাম আমার বাচ্চা মেয়ে বাংলার বদলে বার্মিজ ভাষায় কথা বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ, তখন থেকেই দুশ্চিন্তা শুরু হয়৷ এ রপর বর্মার সামরিক সরকার ঘোষণা করল , সে দেশে থাকতে গেলে নাগরিকত্ব নিতে হবে তখন আর উপায় ছিল না৷ তাই৷ ১৯৬৭তে উদ্বাস্ত্ত হয়েই চলে এলাম৷ তার পর , এ দেশের সরকার ‘৬৮ -তে বারাসতের এই বর্মা কলোনিতে জমি আর ঘর দিল৷ ’ ৫০ বছর এ দেশে বাস করলেও রানি কিংবা সাবিত্রীর জন্মভূমি বর্মার প্রতি আজও যে অদম্য টান তা লক্ষ করার মতো৷ দু’জনেই আজও ওঁদের বর্মা -জীবনের ইতিবৃত্ত সযত্নে লালন করে রেখেছেন৷
বারাসতের বর্মা কলোনি থেকে বেরিয়ে আসার সময় কথা হল মুদির দোকানদার শিবশঙ্কর মজুমদারের সঙ্গে৷ মধ্য পঞ্চাশের শিবশঙ্কর বর্মা ছেড়েছেন নিতান্তই ছেলেবেলায়৷৷ চার -পাঁচ বছর বয়সে৷ আজ রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখে বিস্মিত শিবশঙ্করের স্বগোতক্তি , ‘কী আশ্চর্য বলুন তো ! আমরা নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম বলে উদ্বাস্ত্ত হয়েছিলাম৷ আর রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিকত্ব দাবি করছে বলে আজ উদ্বাস্ত্ত !’