Thursday, January 12, 2017

টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বন্ধুর পাশে বারাসত কালীকৃষ্ণ বিদ্যালয়ের সহপাঠীরা

 অসম্ভব একটা যুদ্ধ৷ তবু জমি ছাড়তে নারাজ কতগুলো কচিমুখ৷ তারাই জড়ো করেছিল ছোট ছোট হাত৷ যা টেনে এনেছে আরও কিছু শক্তপোক্ত হাতকে৷ তারই জোরে লড়াইয়ের রসদ পাচ্ছেন এক দম্পতি৷ দুর্ঘটনার জেরে এখন তখন মেয়ের চিকিত্সা করাতে গিয়ে যাঁরা নাওয়া খাওয়া ভুলেছেন প্রায় এক মাস৷ আশঙ্কাজনক অবস্থায় কলকাতার ইএম বাইপাস লাগোয়া একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে ১৪ বছরের ঐশিকী চট্টোপাধ্যায় (রিনি )৷ দশম শ্রেণির ওই ছাত্রীর চিকিত্সার জন্য প্রয়োজন বিপুল অর্থ৷ বেসরকারি হাসপাতালে বিল উঠেছে ২৫ লক্ষ টাকা৷ ওই পরিমাণ টাকার সংস্থান কোথা থেকে করবেন তা ভেবে রাতের ঘুম উবে যায় পেশায় ঠিকাদার সংস্থার সামান্য কর্মী ভাস্করের৷ বারাসতের নবপল্লি এলাকায় চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা চিকিত্সার খরচ ভেবে যখন ঘোর অন্ধকারে তখন তাদের কাছে এক টুকরো আলো নিয়ে হাজির মেয়েরই স্কুলের সহপাঠীরা৷


দেবর্ষিণি দত্ত , শ্রিয়া চক্রবর্তী, অঙ্কিতা সাধুখাঁ ও সুপর্ণা ঘোষ৷ সবাই মিলে ঠিক করে , বন্ধুর চিকিত্সার জন্য তারা তুলে দেবে প্রতিদিনের টিফিনের পয়সা৷ একই সঙ্গে ঐশিকীর চিকিত্সার জন্য তারা নিজেদের স্কুল বারাসত কালীকৃষ্ণ বিদ্যালয়ের অন্যান্য ছাত্রীর থেকে ইতিমধ্যে সংগ্রহ করে ফেলেছে ১৭ হাজার টাকা৷ কিশোরীদের কেউ কেউ হাত পেতেছে আত্মীয়দের কাছেও৷ হাসপাতাল সূত্রের খবর , মাথার খুলিতে অস্ত্রোপচার , পায়ে অস্ত্রোপচারের হওয়ার পর আগের তুলনায় কিছুটা উন্নতি হয়েছে ঐশিকীর৷ কিন্ত্ত দুর্ঘটনায় তার খুলির একাংশ এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত যে , সেই অংশটি এখন আলাদা করে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে৷


মাথার খুলিহীন অংশে ঢেকে রাখা হয়েছে ফাইবারের আস্তরণ দিয়ে৷ বুধবারই তাকে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট সিস্টেম থেকে বের করে আনা হয়েছে৷ যদিও এখনও সংঙ্কটমুক্ত নয় সে৷কী ঘটেছিল ? ১২ ডিসেম্বর পরীক্ষা শেষে মা ও পিসির সঙ্গে মামারবাড়ি কৃষ্ণনগরে গিয়েছিল ঐশিকী৷ সেখানেই পড়ে গিয়ে পায়ে গুরুতর চোট লাগে তার৷ বাসে -ট্রেনে ফিরতে একমাত্র মেয়ের সমস্যা হবে ভেবে একটা ইন্ডিকা গাড়ি ভাড়া করে চট্টোপাধ্যায় পরিবার৷ ওই গাড়িতে বসেই ১৫ ডিসেম্বর বারাসতে ফিরছিল দশম শ্রেণির ছাত্রী৷ বারাসত -জাগুলিয়ার দিকে যাওয়ার পথে একটি বাস হঠাত্ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টো দিক থেকে আসা সেই গাড়িটির পাশে ধাক্কা মারে৷


আশ্চর্যজনক ভাবে গাড়ির চালক , মা ও পিসি অক্ষত থাকলেও গুরুতর আহত হয় ১৪ বছরের কিশোরী৷ মাথা ও পায়ে ভয়ানক আঘাত লাগে তার৷ তড়িঘড়ি স্থানীয় বাসিন্দাদের তত্পরতায় পরিবারের সদস্যরা প্রথমে তাকে বারাসত মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যান৷ তবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন , অবিলম্বে মাথার অস্ত্রোপচার না করলে কিশোরীকে বাঁচানো সম্ভব নয়৷ এর পর তাকে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেও জানানো হয় একই কথা৷


একমাত্র সন্তানকে বাঁচাতে ওই রাতেই ইএম বাইপাস সংলগ্ন বেসরকারি হাসপাতালে মেয়েকে নিয়ে আসেন বাবা ভাস্কর৷ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে চিকিত্সার খরচ শুনে মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের৷ সে সময় আঁধারপথে আলোবর্তিকা হয়ে ওঠে তার সহপাঠীরা৷ আদরের একমাত্র ভাগ্নির চিকিত্সার খরচ তুলতে ফেসবুকে ‘ফাইট ফর রিনি ’ নামে একটি পেজ খুলে ফেলেন মামা পেশায় ইঞ্জিনিয়ার সৌম্যব্রত রায়চৌধুরীও৷ চিকিত্সার জন্য সাহায্য মেলে , এমন একটি ওয়েবসাইটেও অ্যাকাউন্ট খোলেন তিনি৷ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ঐশিকীর চিকিত্সার জন্য ১৫ লক্ষ টাকা পাওয়া গিয়েছে৷


বাকি ৬ লক্ষ টাকা দিয়েছেন আত্মীয় , বন্ধুবান্ধব ও বারাসত পুরসভা৷ সৌম্যব্রত বলছেন ,‘বন্ধুদের পরামর্শেই সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বারস্থ হয়েছিলাম৷ তবে এতটা সাড়া মিলবে তা ভাবিনি৷ সকলের কাছে আমরা ঋণী৷ ’পরিবারের দরজায় সাহায্যের ঝাঁপি নিয়ে হাজির প্রতিবেশী থেকে স্কুলের শিক্ষিকারাও৷ বিপদের দিনে মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত মনে করেন বলেই চট্টোপাধ্যায় পরিবারকে আর্থিক ভাবে সাহায্য করেছেন বলে জানালেন দমদমের বাসিন্দা পেশায় ব্যবসায়ী জয়ন্ত বাগচী৷ তিনি বলছেন , ‘আমি একা নয় , আমাদের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অনেকেই ঐশিকীর চিকিত্সার জন্য সাহায্য করেছেন৷ ’


স্থানীয় কাউন্সিলর দীপক দাশগুপ্তও নিজে উদ্যোগী হয়ে ওয়ার্ডে ঘুরে ঘুরে ওই ছাত্রীর চিকিত্সার জন্য ৫০ হাজার টাকা তুলে দিয়েছেন৷ যদিও তিনি এতে নিজের কৃতিত্ব মানতে নারাজ৷ ‘ঐশিকীর চিকিত্সায় যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তাতে ওই টাকা সমুদ্রে একবিন্দু জলের মতো ,’ বলছেন দীপক৷ ১ লক্ষ টাকা দিয়েছেন ঠিকাদার সংস্থার মালিক সৌরেন দেও৷ পেশায় ঠিকাদার সংস্থার কর্মী বাবা ভাস্কর বলছেন , ‘আমার যা ক্ষমতা তাতে সকলে সাহায্য না করলে মেয়েটাকে হয়তো এত দিন বাঁচাতে পারতাম না৷ ’ আর কান্নাভেজা গলায় বারাসতের বাড়িতে বসে মা সোমা বলছেন , ‘মেয়েটাকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারব কি না জানি না৷


তবে বিপদের দিনে যে ভাবে সবাই পাশে দাঁড়ালেন তা দেখে এটা বুঝেছি , ভালো মানুষ যে এখনও আছে৷ ’শহুরে মধ্যবিত্তরা এখন ছেলেমেয়েদের এলাকার বাংলা মাধ্যম স্কুলে পাঠান না৷ মফস্সলের একটি বাংলা মাধ্যম স্কুলও জীবন -মরণের এই যুদ্ধে জড়িয়ে উঠে এসেছে আলোর বৃত্তে৷ এ ভাবে সহপাঠীকে বাঁচাতে ছাত্রীরা এগিয়ে আসায় খুশি স্কুলের শিক্ষিকা সঙ্ঘমিত্রা বসু৷ ইংরেজির এই শিক্ষিকা বলছেন , ‘ভেবেও ভালো লাগছে যে , আমি এই স্কুলের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত৷ তবে ঐশিকী দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠলে আরও ভালো লাগবে৷ ’ স্কুল থেকে অর্থ সংগ্রহের কাজ এখনও চলছে৷ যে উদ্যোগে জড়িয়ে আছে একটা আকুতিও --- ‘ফাইট রিনি ফাইট৷ 

Source: Ei Samay